ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, বেশি সংখ্যক নমুনার জিন নকশা ভবিষ্যতে দেশের করোনাভাইরাসটির প্রধান জাত এবং এ সম্পর্কিত অন্য জাতগুলোর জন্য কার্যকর প্রতিষেধক তৈরি করতে সহায়তা করবে।
ডা. সমীর কুমার সাহার মেয়ে এবং ঢাকা শিশু হাসপাতালে চাইল্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) গবেষক ডা. সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে সিএইচআরএফের আট সদস্যের একটি গবেষক দল গত ১২ মে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নভেল করোনাভাইরাসের (সার্স-কোভ-২) জিনোম সিকোয়েন্সের ম্যাপিংয়ের কাজ করে। ঢাকার সিএইচআরএফের পরীক্ষাগারে তারা পুরো কাজটি সম্পাদন করেন।
ফাউন্ডেশনটির লক্ষ্য ছিল দেশে কোভিড-১৯ এর বিস্তারকে পর্যবেক্ষণ করতে এর প্রসার ও সংক্রমণ ধরনগুলো ভালোভাবে বোঝার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আরও বেশি করে নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়েলজি বিভাগের অধ্যাপক সমীর সাহা বলেন, ‘আমরা এর ওপর আরও গবেষণার কাজ করব। আমাদের সংস্থা ছোট হলেও এবং একটি ছোট মেশিন নিয়ে কাজ করলেও আমাদের আশা অনেক বড়।’
সম্প্রতি পাওয়া তাদের সাফল্যের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষে দেশে ক্রমবর্ধমান করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরীক্ষা বাড়ানো পরে আমাদের সংস্থা ভাইরাসটির নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করছিল।
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিংটা আমাদের উপজাতীয় কাজ। এর অর্থ হলো অন্য কাজ করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময়ে আমরা এ কাজটি করেছি। বেসরকারি সংস্থা হলেও আমরা সরকারের সাথে এ কাজ করছি। সরকার যখন ধীরে ধীরে কোভিড-১৯ পরীক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি করছিল, তখন আমাদেরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।’
‘তারপরেই সিএইচআরএফ দেশের বিভিন্ন জায়গার থেকে অনেক নমুনা পেতে শুরু করেছিল এবং সেগুলো পরীক্ষা করার পরে প্রতিবেদনগুলো সরকারের কাছে পাঠাচ্ছিল। একই সাথে আমরা কিছু নমুনা সংরক্ষণ করেছি। এটাও আমাদের দায়িত্ব,’ যোগ করেন তিনি।
জিনোম সিকোয়েন্স করা করোনাভাইরাসের নমুনাটি যার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে ডা. সমীর বলেন, গত ১৮ এপ্রিল একজন ব্যক্তির কাছ থেকে সিএইচআরএফ কোভিড-১৯ এর নমুনাটি সংগ্রহ করেছিল।
দেশে করোনাভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সাথে কোনো বিদেশি জড়িত ছিলেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তরুণ বাংলাদেশি গবেষকদের নিয়ে কোভিড-১৯ সিকোয়েন্সিং দলটি গঠন করা হয়েছে। দলের কয়েকজন সদস্য সবেমাত্র পিএইচডি করেছেন, আবার কেউ কেউ পিএইচডি করছেন বা পিএইচডি কোর্স করবেন।
বাংলাদেশে ভাইরাসটি কোথা থেকে এসেছে?
সিএইচআরএফের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘কোথা থেকে ভাইরাসের এ জাতটি বাংলাদেশে এসেছে সে বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারলে ভালো হত। আমরা গবেষণায় সে বিষয়টি নিয়ে মনোনিবেশ করতে পারিনি। তাবে, আমরা মনে করি ভাইরাসটি যুক্তরাজ্য থেকে আমাদের দেশে এসে থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এখন অবধি, আমরা মনে করছি এ ভাইরাস যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে। আমরা এটি সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত। তবে রাশিয়া, তাইওয়ান এবং সৌদি আরবেও একই ধরনের জাত দেখা গেছে।’
আরও অধিক নমুনা বিশ্লেষণের বিষয়ে জোর দিয়ে বিশিষ্ট এ মাইক্রোবায়োলজিস্ট বলেন, ‘আমরা যখন আরও নমুনার জিন নকশা করব তখন যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের নাম জানতে পারব। যেখানে থেকে এ ভাইরাসটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখানে এসব বিষয় (খুঁজে পাওয়া) গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভাইরাসটি আমাদের দেশে প্রবেশের পরে এর কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না এবং এ পরিবর্তন আমাদের দেশের পরিস্থিতির জন্য ভালো নাকি আরও অবনতি ঘটাবে তাও আমরা জানতে পারব।’
কার্যকর প্রতিষেধকের খুঁজে
খুব দ্রুতই কোনো প্রতিষেধক পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে চলতি বছরের শেষে বা পরের বছরের শুরুর আগে তা আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও মনে করেন ডা. সমীর সাহা।
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না এ সময়ের মধ্যে করোনাভাইরাসটি কতগুলো জাত পরিবর্তন করেছে। আমরা যদি ১০০ জাতের জিন নকশা করতে পারি তবে আমরা আরও অনেক বিষয় জানতে পারব। আমরা যদি আরও বেশি সংখ্যক জিন-নমুনা পরীক্ষা করতে পারি তবে এটি আরও ভাল হবে।’
‘যদি আমরা এটি করতে পারি তবে বুঝতে পারব যে আমাদের দেশের ভাইরাসগুলোর জন্য কোন প্রতিষেধকটি কার্যকর হবে বা আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়া একটি ভাইরাস বা সবগুলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিষেধকটি কাজ করবে কি না। আমাদের দেশে ভাইরাসের কোন জাতটির সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে তাও আমরা বলতে পারব,’ যোগ করেন তিনি।
সময়ের সাথে সাথে ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করে এ বিজ্ঞানী বলেন, আমেরিকাতে ফ্লু ভাইরাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য দেয়া টিকাও প্রায় প্রতি বছর পরিবর্তন করা হয়।
তবে, বাংলাদেশে কোন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা রয়েছে তা না জানান কারণে বছরের পর বছর ধরে একই ধরনের প্রতিষেধক ব্যবহৃত হয়ে আসছে বলে জানান অধ্যাপক সমীর।
সবাই মিলে কাজ করলে বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য কোন টিকা প্রয়োজন সে বিষয়টি জানা যাবে বলে জানান তিনি।
সিএইচআরএফ সম্পর্কে
২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সিএইচআরএফ সম্পর্কে বলতে গিয়ে অধ্যাপক সমীর বলেন, ‘ফাউন্ডেশনটি গত দুই বছর ধরে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ করছে। আমরা চিকুনগুনিয়া, নিউমোনিয়া এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এবং সম্প্রতি ডেঙ্গুর জিন-নকশা করেছি।’
মাইক্রোবায়োলজিতে অসামান্য অবদান এবং এর প্রয়োগের জন্য অধ্যাপক সমীর সাহা ও পাকিস্তানের ডা. শাহিদা হাসনাইন যৌথভাবে ২০১৩ কার্লোস জে. ফিনলে ইউনেস্কো পুরস্কার জিতেছেন।
ডা. সমীরকে ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলজির গবেষণার জন্য ২০১৩ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (এএসএম) পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। প্রথমবারের মতো উন্নত বিশ্বের বাইরের কোনো উন্নয়শীল দেশ থেকে এ পুরস্কারের জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দেশে প্রথম কোভিড-১৯ এর জিন নকশার কাজে নেতৃত্বদানকারী তার কন্যা ঢাকা শিশু হাসপাতালে চাইল্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক ডা. সেঁজুতি সাহার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক সমীর বলেন, ডা. সেঁজুতি বাংলাদেশে ও লেভেল এবং এ লেভেল শেষ করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য কানাডা যান।
কানাডায় ১২ বছর অবস্থানকালে সেঁজুতি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করার পরে সেখানে মলিকুলার জেনেটিক্সে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি শেষ করার পরে তিনি বাংলাদেশে এসে পেশাজীবন শুরু করেন। তিনি বেসিক সায়েন্স এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। গত চার বছর ধরে সিএইচআরএফ পরীক্ষাগারে গবেষক দলের সাথে কাজ করছেন সেঁজুতি।
ডা. সেঁজুতি গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন গেটস গোলকিপার্স অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও গবেষণা সমতার বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেন।